পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে

বেড়াতে ভালোবাসি ছোট থেকেই।  দু মাসের ছুটি নিয়ে, July এর শেষে  husband  এর কাছে জুরিখ, Switzerland  বেড়াতে এসেছি। ইউরোপে  এর আগে এলেও তা কর্মসূত্রে।  বেড়ানোর সুযোগ ঠিক হয়ে ওঠেনি। হাতে ছুটি নিয়ে এই প্রথমবার। এ সুযোগ হাতছাড়া করার নয়।  আর গ্রীষ্মকাল, ইউরোপে  ঘুরবার আদর্শ সময়।   প্রতি উইকেন্ডেই জুরিখ  থেকে কাছাকাছি কোথাও ঘুরছি। এক উইকেন্ডে  ঠিক করা হলো, একটু দূরে ইন্টারলাকেন ঘুরতে যাবো। ইন্টারলাকেন..যার আক্ষরিক অর্থ, দুটি বা অনেকগুলি লেক এর মধ্যবর্তী অঞ্চল। নামের সাথে সামঞ্জস্য রেখে, শহরটি আসলে তাই।  একপাশে লেক Brienz, আরেক পাশে লেক থুন।  শহরের বুক চিরে চলে গেছে আঁরে নদী, যা দুটি লেকের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করেছে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৮৫৭ ফুট উঁচুতে, ছোট্ট দুটি  লেক আর পাহাড় ঘেরা শহর, শীতের সময় যা পুরু বরফের আস্তরণে ঢাকা পড়ে যায়।  আর গ্রীষ্মকালে প্রকৃতি তার অপরূপ সবুজ সম্ভার মেলে ধরে। 
হাতে সময় মাত্র দুদিন।, শনিবার আর রবিবার।  পরিকল্পনা  শনিবার খুব সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়ে, রবিবার রাতে বাড়ি ফেরা। জুরিখ থেকে ইন্টারলাকেন যাওয়ার ডাইরেক্ট কোনো ট্রেন নেই। একবার অথবা দুবার ট্রেন চেঞ্জ করতেই হবে, রুট অনুযায়ী। তবে এখানে এতো ঘন ঘন ট্রেন, আর  সিট নিয়েও কোনো সমস্যা নেই, তাই বারবার ট্রেন চেঞ্জ করাটা খুব সমস্যার নয়।  আর তাছাড়া হাতে সুইস পাস থাকলে বার বার টিকিট  কাটার ঝামেলাও নেই।  এক টিকিটেই সারাদিন যত খুশি ট্রেন, ট্রাম, বাস, বোটে  ঘোরা যায়, স্পেসিফিক কিছু মাউন্টেন রেল ছাড়া।  আর গুগল ম্যাপ এ ডেস্টিনেশন লিখলেই বলে দেয় কখন কিভাবে যেতে হবে।  আমরা দুবার ট্রেন চেঞ্জ করেছি। প্রথমে জুরিখ থেকে বার্ন, তারপর বার্ন থেকে Spiez,  Spiez থেকে ইন্টারলাকেন Ost রেলওয়ে স্টেশন। ভোরবেলা তল্পিতপ্লা গুছিয়ে কপোত-কপোতী  বেরিয়ে পড়লাম। 

৬:৩০ নাগাদ  জুরিখ থেকে  ট্রেন ধরে, ইন্টারলাকেন পৌছাতে প্রায় সকাল ৮:৩০। ঠিক করা হল, এখনই শহরটা না  ঘুরে, প্রথমে ট্রেনে করে Brienz যাব এখান থেকে, তারপর লেক Brienz এ বোট এ চেপে ইন্টারলাকেন ফিরব। আরও প্রায় ২৫ মিনিটে ট্রেন এ চেপে Brienz পৌছালাম। এই ছোট্ট শহর টি Brienz লেক এর আরেক প্রান্তে অবস্থিত। লেক এর পাড় সুন্দর ফুলে  সাজানো, কোথাও কোথাও অপূর্ব কাঠের তৈরী ভাস্কর্যও চোখে পড়বে। চোখ আরেকটু উপরে তুললে, নানারকম সবুজে সাজানো উপত্যকা, মাঝে ছোট ছোট কাঠের বাড়ী। হাঁসেরা খেলা করে বেড়াচ্ছে লেক এর জলে, কোথাও বা কেউ রোয়িং করছে। কেউ বা লেক এর ধারে বসে, বইতে মুখ ডুবিয়ে সূর্যের তাপ উপভোগ করছে।  ঘন্টাখানেক লেক সাইড ঘুরে বোটে  ওঠা হল।  মাঝে কয়েকটি ছোট ছোট হল্ট পেরিয়ে গন্তব্য ইন্টারলাকেন। নীলচে সবুজ জল কেটে  প্রায় ঘন্টাদেড়েক এর পথ। টেম্পারেচার ২৫ এর কাছে, কিন্তু রোদের তাপ গায়ে লাগেনা। দুপাশে চোখ জুড়ানো  সবুজে মাখা উপত্যকা হাতছানি দেয়।         
            
ইন্টারলাকেন বোট ডক, ইন্টারলকেন Ost রেলস্টেশন এর পাশেই। সেখানে পৌছে দেখা হলো কলেজের বন্ধু আর তার সঙ্গীর  সাথে। তারাও উইকেন্ডে  ইন্টারলাকেন বেড়াতে এসেছে। বন্ধুসঙ্গে যাত্রা আরো মধুময় হয়ে উঠলো। ঠিক হলো, একসাথে সবাই Harderkulm যাওয়া হবে funicular এ চেপে ( এর টিকিট সুইস পাস্ এ পুরো ফ্রি নয় , ৫০% ডিসকাউন্ট পাওয়া যায় ) ।   Ost স্টেশন থেকে হেঁটে প্রায় ৭/৮ মিনিট funicular স্টপ। Harderkulm ওখানকার সর্বোচ্চ পয়েন্ট, ৪৩৩৪ ফুট উঁচুতে। Funicular এ যেতে প্রায় ১৫ মিনিটের কাছে লাগে। Herderkulm থেকে পুরো ইন্টারলাকেন শহরটা দেখা যায়।  ওখান থেকে ফোটো তুললে একদম ম্যাপ এর মতো দেখতে লাগে। সময় আর শারীরিক সামর্থ্য থাকলে ট্রেক করেও ওখানে ওঠা যায়। Harderkulm  ঘুরে নিচে নামতে প্রায় বিকেল ৩ বেজে গেল।  এবার বন্ধুবিদায় এর পালা। তারা যাবে অন্য কোথাও, অন্য কোনো স্টেশনে।  আর আমাদের পরবর্তী গন্তব্যস্থল জার্মাট।          

সময় থাকলে ইন্টারলাকেন থেকে আরেকটি  মনোহর জায়গায় যাওয়া যেত, জুংফ্রাউজক,  সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১১,৩৭১ ফুট উঁচুতে। ইন্টারলাকেন থেকে ট্রেন আছে via kleinne  scheidegg । কিন্তু যেহেতু এটি মাউন্টেন রেল অপারেট করে, আলাদা টিকিট কিনতে হয়।  তবে সুইস পাস বা সুইস ১/২ ফেয়ার থাকলে, টিকিটে কিছু ছাড় পাওয়া যায়। জুংফ্রাউজক ইউরোপের সর্বোচ্চ রেল স্টেশন,  ইন্টারলাকেন থেকে যেতে সময় লাগে ২ ঘন্টা। আমাদের কাছে যথেষ্ট সময় না থাকায় যেতে পারিনি। 

এবার পরিকল্পনামাফিক জার্মাটমুখী হলাম। ইন্টারলাকেন Ost থেকে এখানেও ডাইরেক্ট ট্রেন নেই।  Spiez ও Visp এ দুবার ট্রেন পাল্টে জার্মাট এলাম।  Spiez শহরটি থুন লেকের ধারে অবস্থিত। রেলের ট্র্যাক ও গেছে একদম লেকের ধার ঘেষে। তাই সময়াভাবে থুন লেক ট্রেন থেকেই দেখলাম। অন্যদিকে Visp  চারদিকে আল্প্স দিয়ে ঘেরা।  Visp থেকে আবার উপরে ওঠার পালা। Visp থেকে জার্মাট যেতে ট্রেনে  ১ ঘন্টা ১০ মিনিট মতো লাগে। এই পথটি অসাধারণ,  চড়াই উৎরাই এ ভরা।  কখনো গভীর খাঁদ, কখনো ছোট ঝোরা , কখনো বা পাহাড়ী খরস্রোতা নদী  পাশে নিয়ে চলেছে এই রেল ট্রাকটি। মাঝে মধ্যে দুপাশে সবুজ গালিচার মধ্যে অসংখ্য রঙ্গীন বুনোফুল আল্পনা এঁকেছে।  জার্মাট ৫৩১০ ফুট উচ্চতায়, Matterhorn পর্বতের পাদদেশে  অবস্থিত খুব ছোট্ট একটি শহর।  শহরটির মূল চালিকাশক্তি ট্যুরিজম। পর্বতারহীদের কাছে এটি বিশেষভাবে আকর্ষণীয়। ছোট বড়  হোটেল, একটা  মিউজিয়াম, চার্চ, খরস্রোতাস্বিনী, আর চারদিকে পাহাড় ঘেরা।  এখানকার আরও একটি অন্যতম আকর্ষণ গ্লেসিয়ার এক্সপ্রেস, যা সবচেয়ে ধীরগামী এক্সপ্রেস ট্রেন নামে পরিচিত। আমাদের প্ল্যান শনিবার রাতটা এখানে হোটেলে কাটিয়ে, পরদিন সকাল বেলা গ্লেসিয়ার এক্সপ্রেসে  ওঠা।   সেইমতো একটা হোটেলে  ওঠা হলো।  আরেকটি বিষয় নজরে আসে, এখানকার অধিকাংশ ঘরবাড়ী কাঠের তৈরী। আমাদের হোটেলটিও কাঠের। জালনা খুলে দিলে বরফমাখা পিরামিডাকৃতি Matterhorn চোখে পড়ে।  

গ্লেসিয়ার এক্সপ্রেস চলে জার্মাট আর সেন্ট মরিটজ এর মধ্যে, প্রায় ৮ ঘন্টা ধরে। মাঝে আরো কয়েকটি স্টেশনে থামে।  জার্মাট থেকে প্রতিদিন সকাল ৭:৫০, ৮:৫০ আর ৯:৫০ এ ট্রেন ছাড়ে। সুইস পাস থাকলে আলাদা টিকিট কিনতে হয়না বটে, তবে ৩৩ সুইস ফ্রাঙ্ক দিয়ে সিট রিজার্ভ করতে হয়।  ট্রেনটার মধ্যভাগ থেকে, ছাদ পর্যন্ত কাচ দিয়ে তৈরী। তাই প্রকৃতি দর্শনে কোনো বাধা নেই।  ৮ ঘন্টা ধরে কোথাও খাঁদ, কোথাও নদী, কোথাও ঝর্ণাকে নিয়ে পথ চলা।  এখন গরমকাল, অধিকাংশ বরফ গলে গেছে। তবুও মাঝেমধ্যে বরফজমা পর্বতচূড়া দেখা যায়। কোথাও কোথাও রঙ্গীন ফুলে ঢাকা উপত্যকা চোখ জুড়িয়ে দেয়।  এই ট্রেনে খাবার, কফি, ড্রিঙ্কস  পাওয়া যায়।  প্রকৃতি দেখতে দেখতে ধোঁয়া ওঠা কফির কাপে ঠোঁট ছোঁয়াতে মন্দ লাগেনা।  

সকাল ৮:৫০ এ গ্লেসিয়ার এক্সপ্রেস চেপে বিকেল প্রায় ৫ টা নাগাদ সেন্ট মরিটজ পৌছালাম। এখানে স্টেশনের পাশেই লেক।  কিন্তু সময় নেই ঘুরে দেখার। আমাদেরকে জুরিখ ফিরতে হবে, প্রায় ৪ ঘন্টার পথ। আর এবারো  ডাইরেক্ট ট্রেন নেই।  চুরে নেমে অন্য ট্রেন নিতে হবে।  সন্ধ্যে ৬ টা নাগাদ  সেন্ট মরিটজ থেকে ট্রেন ধরে ঘরে পৌছাতে রাত ১০ টা বেজে গেল।  মনভরা আনন্দ আর ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঠিক করা হলো এরপর একবার শীতের সময় ইন্টারলাকেন, জার্মাট যেতে হবে।  আর তখন জুংফ্রাউজক বাদ পড়লে চলবেনা।    


Comments

  1. Chaliye jao.. Darun.. Besh bhal laglo porte..

    ReplyDelete
  2. Ei to chai! Khub bhalo legeche lekhata.

    ReplyDelete
  3. Asadharan lekha...jodio lekhata tor chhoto bela thekei ase...:D

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

মাখনবন্দী ওটস

কাবলি ছোলার পোলাও  

Ragi cheela no. 1